উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের মানুষ, ঈশ্বর সাধনায় মগ্ন থাকা এক ব্যক্তিত্ব, অথচ কেবল আত্ম উপলব্ধি নিয়ে ঈশ্বরের দিকে নিজের মনকে তিনি কখনো আবদ্ধ রাখেননি। নিজের সাধনালব্ধ অভিজ্ঞতা-এবং মননকে তিনি প্রসারিত করেছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে মানবজাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে।
উনিশ শতকের নবজাগরণের সিংহভাগ ব্যক্তিত্ব ছিলেন উচ্চবর্ণের হিন্দু অভিজাত পরিবার থেকে আসা। সেই জায়গায় শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র গ্রামীণ পটভূমিকার মধ্যেদিয়ে। তাঁর বা তাঁর পরিবারের কোনো প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ ছিল না বলা যেতে পারে। প্রথাগত শিক্ষার সুযোগকে শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেও কখনো গ্রহণ করতে চাননি। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়া মানুষটিই মানবসমাজের অন্যতম সেরা শিক্ষক হিসেবে নিজেকে কেবল স্বকালেই নয়, ভাবিকালের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন।
ভক্তি আন্দোলন, যেটি আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছরেরও বেশি আগে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের মাধ্যমে বাংলার বুকে এক জাতি-ধর্ম-বর্ণ বিভাজনকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। পরবর্তী সময়ে নানা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক চাপানউতরে, শ্রীচৈতন্যের ভাবধারার সেই মূল সুরটি অনেক অংশেই অদলবদল হলেও, উনিশ শতকে, ভেদাভেদবিহীন মানবপ্রেমের প্রচার ও প্রসারে, কোনো অবস্থাতেই নিজের ভাবনাকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে, অপরের ভাবনা, অপরের বিশ্বাস, তাকে খাটো করা, এই বোধকে ‘মতুয়ার বুদ্ধি’, যার ইংরেজি তর্জমা করা হয়েছে ‘ডগ্নাটিজিম’, সেই বোধ, মানবসমাজে পরিবেশন করবার ক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাকে ঐতিহাসিক বললেও বোধ হয় খুব কম বলা হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের জীবন দিয়ে মুক্ত বুদ্ধির উন্মেষের যে উদাহরণ রেখে গিয়েছেন, উনিশ শতকে তেমনভাবে নিজেকে বিবর্তিত করে, বিভাজন বিহীন একটা সামাজিক ব্যবস্থার চিন্তা খুব কম মনীষী করেছেন। উদাহরণসহ বললে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হবে বিষয়টি। দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে যখন তাঁর জ্যেষ্ঠগ্রজ রামকুমার চট্টোপাধ্যায় মন্দিরের পূজারির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, তখন কিন্তু মা ভবতারিণীর ভোগ প্রসাদ পর্যন্ত শ্রীরামকৃষ্ণ খেতেন না। যেহেতু মন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী রানি রাসমণি নিম্নবর্গীয় সমাজ থেকে উঠে আসা একজন মানুষ, তাই সেকালের গ্রাম বাংলার যে জাতপাতজনিত সংস্কার, সেই সংস্কারের কারণেই আলাদা করে নিজের হাতে আহার প্রস্তুত করে নিতেন শ্রীরামকৃষ্ণ। আর এই মানুষটিই নিজের অধ্যাত্য সাধনার ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে দত্তকুলোৎভব নরেন্দ্রনাথকে বা ঘোষকুলোড়ব রাখালকে নিজের মানস সন্তান হিসেবে গোটা সমাজের কাছে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। নরেন্দ্রনাথ, পরবর্তীকালের ভুবনজয়ী স্বামী বিবেকানন্দ। আর রাখাল হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম অধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দ।
উনিশ শতকের মধ্যভাগে কলকাতার উপকণ্ঠে অবস্থান করে জাতপাতের বেড়ায় কেবল নয়, ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতার আবরণ ভেদ করা খুব একটা মুখের কথা ছিল না। সেই সময়ের প্রচলিত ধর্মীয় ভাবধারা এবং সেই ভাবধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিত্বেরা বর্ণবাদকে এতটাই বেশি গুরুত্ব দিতেন যে, নিম্নবর্গীয় হিন্দুরা প্রাতিষ্ঠানিক দেবদেবতার পূজার্চনা করা তো দূরের কথা, মন্দিরে উঠবার পর্যন্ত অধিকারী ছিলেন না।
অনেক পরে বিশ শতকের মধ্যভাগে নিম্নবর্গীয় হিন্দুরা, যাদের সেই সময় ‘অস্পৃশ্য’ বলা হতো, গান্ধীজি তাঁদের নাম দিয়েছিলেন ‘হরিজন’, আর এই হরিজনদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকারের জন্য রীতিমতো সামাজিক আন্দোলন তিনি করেছিলেন, এই আন্দোলন করবার জন্য সেই সময় রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের বহু বিদ্রুপ-সমালোচনা গান্ধীজির প্রতি বর্ষিত হয়েছিল। এই সময়কালেরও প্রায় ষাট-সত্তর বছর আগে, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে মেথরের কাজ করতেন রসিক নামক এক ব্যক্তি, তিনি ছিলেন অত্যন্ত ঈশ্বরানুরাগী, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, সেকালে কোনো বর্ণ হিন্দু বা বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব একজন মেথরের বাড়িতে যাওয়া এবং সেখানে গিয়ে খাদ্য-জল গ্রহণ করা এটা যখন ভাবতেই পারত না, শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু তখন, সমস্ত রকমের সংকীর্ণতাকে হেলায় অস্বীকার করে, রসিকের বাড়িতে যান এবং সেখানে খাদ্য গ্রহণ করেন।
আমাদের মনে রাখা দরকার, শ্রীরামকৃষ্ণ খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে বিশেষ রকমের সতর্ক ছিলেন। কিন্তু সেই সতর্কতা ছিল তাঁর জাতপাত ঘিরে নয়, ধর্ম ঘিরেও নয়। সতর্কতা ছিল যার আনা খাবার বা যার হাত দিয়ে সেটি প্রস্তুত হয়েছে, সেই ব্যক্তিটির যাপন চিত্রজনিত। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন অনুশীলন করলে আমরা দেখতে পাই, সমাজে ব্রাত্য বহু মানুষকে তিনি অহেতুক কৃপা করেছেন। তাঁদের আনা অতি সামান্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে তৃপ্তিসহ খেয়েছেন। কোনো ধনীর আনা মহামূল্য খাদ্যসামগ্রীকে হেলা করে হতদরিদ্র মানুষের আনা অতি সামান্য খাবার, সেগুলো গ্রহণ করেছেন। কিছু মানুষ আছেন যারা অন্ধের হস্তি দর্শনের মতো শ্রীরামকৃষ্ণের গোটা জীবনের সামগ্রিকতাকে বিচার না করে, একটি-দুটি ঘটনা স্থানিক বিন্দুতে তুলে এনে, তাঁর সম্বন্ধে একটা মূল্যায়ন করে বসেন। যেমন অনেকেই লেখেন, ব্রাহ্মণ ব্যতীত কারও হাতে শ্রীরামকৃষ্ণ অন্ন গ্রহণ করতেন না।
এই ধরনের তথ্য যারা পরিবেশন করেন, শ্রীরামকৃষ্ণের গোটা
জীবনের যে কর্মপদ্ধতি, সে সম্পর্কে আদৌ তারা সঠিকভাবে অবহিত নন। ঘোষকুলোদ্ভব, বাগবাজারের বলরাম ঘোষের অন্নকে তিনি, ‘শুদ্ধ অন্ন’ বলে বারবার উল্লেখ করেছেন। নিজে বলরামের গৃহে একাধিকবার গিয়েছেন, রাত্রিযাপন করেছেন এবং অন্ন গ্রহণ করেছেন।
ব্যক্তি বলরামের জাত বিচার নয়, তাঁর গোটা জীবনের সৎ যাপনচিত্র এটাই ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে বলরাম ঘোষের একমাত্র পরিচয়। ঠিক তেমনি, সাধারণ সামাজিক অবস্থানে অবস্থান না করা, নটী বিনোদিনীকে যেমন থিয়েটার দেখতে গিয়ে আশীর্বাদ করেছেন, আবার তেমনি জীবনের শেষ পর্বে, শ্যামপুকুর বাটীতে তাঁর অবস্থানকালে, বিনোদিনী যখন সাহেবের ছদ্মবেশে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করতে আসেন, তখনো শ্রীরামকৃষ্ণের অহেতুক কৃপা থেকে বিনোদিনী দাসী বঞ্চিত হননি।
যুগ-যুগান্তরব্যাপী প্রবাহিত ভারতীয় আধ্যাত্মিক জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি কেবল নিজের ধর্মে সাধনভজন করেই সাধনার পর্বে ইতি টানেননি। অধ্যাত্ম্যের নিগূঢ় তত্ত্ব অনুভব করতে তিনি যেমন খ্রিষ্টান ধর্মে সাধনা করেছেন, তেমনি পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, ইসলাম ধর্মের যাবতীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে সাধনা করেছেন।
সুফি সন্তু গোবিন্দ রায়ের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের পবিত্র ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণের পর যে সাধনা এবং যাপন পদ্ধতি, অর্থাৎ, যে মানুষটি তৎকালীন সংস্কারে পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি দ্বারা প্রস্তুত খাদ্য গ্রহণ করতেন না, সেই মানুষটিই পবিত্র ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়ে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বার কালে, পেঁয়াজ-রসুন ইত্যাদি দিয়ে তৈরি খাদ্যদ্রব্য অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের সমন্বয়ী চেতনা, যেটিকে তিনি অত্যন্ত সাধারণ আটপৌরে শব্দ, ‘যত মত তত পথ’ দিয়ে মানবসমাজে একটা অভিনব চেতনা সৃষ্টি করে গিয়েছেন, সেটি ছাড়াও তাঁর আরেকটি বিশেষ ঐতিহাসিক অবদান হলো; নারীসমাজকে, একটা সম্মান-মর্যাদার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত না করতে পারলে যে নিজের জীবনে বা সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় না, মানুষের ভালো করতে পারার চেষ্টাকে প্রসারিত করতে পারা যায় না-সেই ধারণাকে কেবল তত্ত্বগতভাবে নয়, প্রয়োগগতভাবেও বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছিলেন।
শ্রীচৈতন্য পরবর্তী সময়ে বাংলায়, হিন্দু বাঙালির জীবনে আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে তন্ত্রের প্রভাব এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিল, যেখানে ঈশ্বর উপাসনা খানিকটা গৌণ হয়ে গিয়ে, তার জায়গা করে নিয়েছিল, বামাচারি সাধন পদ্ধতি। এই ভাবধারার চর্চাতে নারীকে একটা ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখানোটাই, প্রচলিত শাস্ত্রকে অতিক্রম করে, প্রচলিত অভ্যাসে পরিণত করেছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু তাঁর নিজের গোটা সাধনপদ্ধতিতে এবং পরবর্তী সময়ে তার যাপনচিত্রের মধ্য দিয়ে নারীসমাজকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে, প্রবহমান ভারতের আধ্যাত্মিক চেতনার যে অন্যতম মূল সুর, নারীর মর্যাদা, তাকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন।
নিজ পত্নী সারদা দেবীকে কেবল ষোড়শী রূপে পূজা করাই নয়, তাঁর মর্যাদা রক্ষায়, একজন স্বামী হিসেবে গোটা জীবন ধরে যে অসাধারণ ভূমিকা শ্রীরামকৃষ্ণ পালন করে গিয়েছেন, তা সার্বিকভাবে বিশ্বের গোটা পুরুষজাতির কাছে একটি বড় রকমের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের একটি ছোট ঘটনার উল্লেখ করলে বিষয়টা আমাদের কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে ওঠে, নিজ পত্নীর প্রতি তথা গোটা নারীসমাজের প্রতি কতখানি সম্ভ্রমপূর্ণ মর্যাদা চিন্তা তিনি বহন করতেন এবং সেই চিন্তাধারা যাতে গোটা বিশ্বের কল্যাণে ধাবিত হয়, সেদিকে নিজের শিষ্য, অনুরাগী, অনুগামীদের পরিচালিত করতেন।
দক্ষিণেশ্বরে থাকাকালীন একদিন কোনো সাংসারিক প্রয়োজনে কেউ তাঁর ছোট্ট ঘরখানিতে প্রবেশ করেছে। সেদিকে লক্ষ না রেখেই আগন্তুকে উদ্দেশ্য করে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন, যাওয়ার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যাস।
শ্রীরামকৃষ্ণ মনে করেছিলেন; তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী লক্ষ্মী এসেছেন। তাই সেই রকম সম্বোধন তিনি করলেন। কিন্তু এসেছিলেন মা সারদা। শ্রীরামকৃষ্ণের কথা শুনে তিনি যখন উত্তরে, ‘হ্যাঁ’ বললেন।
তখনই শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝতে পারলেন, খুব বড় একটা ভুল তিনি করে ফেলেছেন। তিনি না বুঝে নিজের পত্নী সারদা দেবীর প্রতি ‘তুই’ উচ্চারণ করে ফেলেছেন। তৎক্ষণাৎ তিনি লজ্জায় পড়ে গেলেন। বারবার ক্ষমা চেয়ে সারদা দেবীর উদ্দেশে বলতে লাগলেন: আমি মনে করেছিলাম, লক্ষ্মী এসেছে। অমনটা বলবার জন্য তুমি কিছু মনে করোনিকো।
নিজের ভুল সম্বোধনের জন্য অনুতপ্ত সুরে শ্রীরামকৃষ্ণ যে কথাগুলো বলতে থাকেন তা শুনে বিশেষ লজ্জিত হয়ে পড়েন মা সারদা। তবু শ্রীরামকৃষ্ণ বারবার বলতে থাকেন, তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পত্রী লক্ষ্মী তাঁর ঘরে এসেছে মনে করেই ‘তুই’ সম্বোধন করেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। কিন্তু লৌকিক শিক্ষার যে অনবদ্য মানদণ্ডে তিনি নিজেকে উন্নীত করেছিলেন, তার তুলনা বোধহয় একমাত্র তিনিই। লোকশিক্ষক হিসেবে শ্রীরামকৃষ্ণের যে ভূমিকা, ধর্মীয় পরিমণ্ডলের ভিতরে যাঁরা তাঁকে বিচার করেন, তার বাইরেও যে মানুষেরা আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী নন, এক অর্থে নাস্তিক তাঁদের কাছেও একটা বড় রকমের আদর্শ তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে অধ্যাত্মবাদ ঘিরে বা ধর্মজীবন ঘিরে কখনো, অতিপ্রাকৃত কিছু বিষয়কে নির্ভর করে মানুষ তার জীবন পরিচালিত করুক, এমন কথা একবারের জন্য বলেননি। মানবজীবনের একমাত্র লক্ষ্য হলো: ঈশ্বর লাভ। এই বোধের ওপর দাঁড়িয়েই শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর নিজের জীবনকে যেমন পরিচালিত করেছিলেন, ঠিক তেমনি তাঁর অনুরাগী, অনুগামীদের জীবন ও পরিচালিত হোক বা আগামী দিনে যাঁরা তাঁর ভাবাদর্শকে ভালোবাসবেন, বিশ্বাস করবেন, তাঁরাও ঠিক সেভাবে তাঁদের জীবনকে পরিচালিত করুক-এটাই তিনি চেয়েছিলেন।
সাধারণভাবে বিশ্বাসী মানুষের কাছে আধ্যাত্মিক ব্যক্তি মানেই বিশেষ কিছু অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী এমনটাই ধরে নেওয়ার রেওয়াজ আছে। সেদিক থেকেও শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন সার্বিকভাবে এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। নিজের অত্যন্ত প্রিয় মানুষ নরেন্দ্রনাথ, যখন পিতার অকাল মৃত্যুর পর কার্যত অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন বিধবা মাতা ও ছোট ভাইদের নিয়ে, তখনো কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ, কোনো অতিপ্রাকৃত বিষয়ের ভেতর দিয়ে নরেন্দ্রনাথের গৃহের অর্থাভাব পূরণ করে দেওয়ার স্বপ্ন দেখান নেই।
সাধারণভাবে মানুষ সাধু-সন্তের কাছে যায়, মামলা মকদ্দমা জেতার আশায়, রোগ ভালো হওয়ার আশায়, সন্তান লাভের আশায়। সেই রকম কোনো ভক্তকে তিনি খুশি করে দেওয়ার জন্য নিজের সাধনার অভিমুখকে পরিচালিত করেননি। বরঞ্চ সাধনার জগতে যে সিদ্ধি অর্জন করলে সাধকের মধ্যে কিছু ভোজবাজির ক্ষমতা জন্মায় বলে প্রচলিত ধারণা
আছে, সেই সিদ্ধিই শ্রীরামকৃষ্ণ চিরদিন ‘বেশ্যার বিষ্ঠা’র মতো ঘৃণ্য বলেই। প্রতিপন্ন করে গিয়েছেন।
নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে, নিজের বিজ্ঞাপনের পথে কিন্তু তিনি এক মুহূর্তের জন্য হাঁটেননি। বরঞ্চ বলা যেতে পারে উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অনেক প্রথম সারির ব্যক্তিত্ব, গ্রামের সহজ সরল প্রথাগত শিক্ষার আলোক না পাওয়া এই মানুষটির কাছে শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় বারবার মাথা নত করেছেন।
যে বিদ্যাসাগর তাঁর সমাজ সংস্কারের জন্য গোটা মানবসমাজের কাছে বিশেষ শ্রদ্ধার মানুষ, সেই বিদ্যাসাগরকে তাঁর অসামান্য গুণের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ অন্তহীন শ্রদ্ধা জানিয়েও, কথা দিয়ে কথা না রাখবার কারণে খুব ক্ষীণ হলেও পরে সমালোচনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে সত্যবাদিতা ছিল একটি বিশেষ রকমের যাপনচিত্রের অঙ্গ। যদি কখনো কোনোভাবে কথার ছলে তিনি কোনো কিছু অঙ্গীকার করতেন, তাহলে সেই অঙ্গীকার রক্ষার ক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে কখনো কোনো রকম ত্রুটি দেখতে পাওয়া যায়নি।
দক্ষিণেশ্বরে একবার একজনের বাগানে যাওয়ার তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক সেই প্রতিশ্রুতি তিনি ভুলে যান। কিন্তু যখন তাঁর মনে পড়ে সেই প্রতিশ্রুতির কথা, তখন প্রায় নিশুত রাত। সেই অবস্থাতেই তিনি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বাগানে যান। বাগানের বাঁশের দরজাটুকু ঠেলে, ভিতরে নিজের একটি পা প্রবেশ করিয়ে, তিনবার মাটিতে পা ঠেকিয়ে উচ্চারণ করেন; আমি এসেছি, আমি এসেছি, আমি এসেছি।
সত্যবাদিতার প্রশ্নে এমনটাই ছিল তাঁর অঙ্গীকার। এমনটাই ছিল তাঁর যাপনচিত্রের ভঙ্গিমা। তাই বাদুরবাগানে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে যখন শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে আসার আমন্ত্রণ জানান, তখন বিদ্যাসাগরমশাই সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার। কিন্তু কার্যত সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করেননি।
শ্যামলী ভট্টাচার্য প্রাবন্ধিক
এই ঘটনাটি কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল। তাঁর এই আচরণ থেকে এটাই বোঝা যায় যে, কারও মনোরঞ্জনের জন্য অসত্য কথা উচ্চারণ করাকে কখনো তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না। সেই জন্যই শ্রীরামকৃষ্ণ বারবার বলতেন; সত্য কথাই কলির তপস্যা।
ঘটনাপঞ্জি ফেব্রুয়ারি
০৪ ফেব্রুয়ারি ১৯২২ পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর জন্ম
০৭ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪
শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের জন্ম
১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম
কবি ও রাজনীতিক সরোজিনী নাইডুর জন্ম
১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৯
১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯
১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম
লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার জন্ম
১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪ দাদাসাহেব ফালকের মৃত্যু
১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৬
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২
কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্ম
অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জন্ম
২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯০৮ কথাকার লীলা মজুমদারের জন্ম
২৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬ প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাইয়ের জন্ম।
লেখক: শ্যামলী ভট্টাচার্য