1. info@www.kalomerkarukaj.com : PEN CRAFT :
  2. sadikurrahmanrumen55@gmail.com : Sadiqur Rahman Rumen : Sadiqur Rahman Rumen
বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:২২ অপরাহ্ন

কৃষ্ণাঙ্গদের সংগ্রাম মানব সভ্যতার এক নির্মম বাস্তবতা: ম.আমিনুল হক চুন্নু

মোঃ সাদিকুর রহমান রুমেন
  • প্রকাশিত: রবিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
  • ৭০২ বার পড়া হয়েছে

 

সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আচার-আচরণ পরিবর্তিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ভাষণ বা বক্তৃতার ও ধরণ পাল্টাতে থাকে। সক্রেটিসকে তাঁর দর্শন, জ্ঞান, সরকারের সমালোচনা ও তরুণ সমাজকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার অপরাধে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯সালে। বিভিন্ন বক্তৃতায় যে কথাগুলো তিনি বলতেন, তা আজও ইতিহাস হয়ে রয়েছে। ‘নিজেকে জানো; মৃত্যুই হলো মানুষের সর্বাপেক্ষা বড় আশীর্বাদ; তুমি কিছুই জানো না-এটা জানাই জ্ঞানের আসল অর্থ; আর মৃত্যুর পূর্বমূহুর্তে তাঁর বলে যাওয়া, ‘আমি মরছি, তুমি বেঁচে থাকবে। কোনটি বেশি ভালো, তা শুধু ঈশ্বরই জানেন। মৃত্যুর ২৪০০বছর পর আজও সক্রেটিস প্রাসঙ্গিক। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াসিংটনে এক জনসভায় মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র তাঁর ভাষণে বলেছিলেন,

*আই হ্যাভ এ ড্রিম’। সেখানে তিনি নাগরিক ও অর্থনৈতিক অধিকার এবং বর্ণবাদের সমাপ্তির কথা বলেছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, জর্জ ওয়াশিংটন আমেরিকাকে স্বাধীন করেছেন, আব্রাহাম লিংকন এনেছেন গণতন্ত্র, তবে মার্কিন দেশকে সভ্য করেছেন মার্টিন লুথার কিং। তাঁর নেতৃত্বে কালো মানুষ পেয়েছে সাদা মানুষের সমান। অধিকার আর সাদা নাগরিকেরা পেয়েছে বর্ণবাদের অভিশপ্ত অহংকার থেকে মুক্তি। তিনি ছাড়া আমেরিকার বড় অংশ সাবেক বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার দশায় পড়ে থাকত। যে দেশে একসময় কালো শিশুরা সাদা শিশুদের সঙ্গে পড়তে আসতো না, যেখানে সাদা যাত্রীদের দেখে বাসের আসন ছেড়ে দিতে হতো, কোন কালো মহিলাকে, কোন শ্বেতাঙ্গিনীকে ভালোবাসার অপরাধে যে দেশে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে কেটে কুটি কুটি করা হতো, মার্টিন লুথারের নাগরিক স্বাধীনতা আন্দোলনের জের ধরে আজ সেই দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ছিলেন একজন আফ্রিকান- আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ বারাক ওবামা। মার্টিন লুথারের মাধ্যমেই আমেরিকার বর্ণবাদ বিরোধী ২০০ বছরের লড়াই পরিণতি পায়।

ফেব্রুয়ারি মাস আমেরিকায় পালিত হয় কৃষ্ণাঙ্গদের (কালোদের) ইতিহাস ( Black History) মাস হিসেবে। এই মাস আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের অতীত ত্যাগ, তিতীক্ষা, জীবনের কাছে জীবন বাজি, সাদাদের কাছে কালোদের বন্দী জীবন, পায়ে শেকল, হাতে বেড়ি, পিঠে চাবুক আর বুটের লাথি খেয়ে যে দিনগুলো পেরিয়ে এসেছে, তার হিসেব করতে বসে। আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে ইতিহাসের পাতা থেকে খুঁজে পাওয়া যায়। এশিয়ার বাদামীরা যোগ দিয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় চা উৎপাদন করার জন্য চট্টগ্রামের চা বাগান থেকে প্রথম শ্রমিক ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল ১৯৬০-৬৫সালের দিকে। ক্যাপ্টেন রিচার্ড নামের একজন বৃটিশ ক্যাপ্টেন ছিল তার হোথা। চা শ্রমিকদের ফিলাডেলফিয়ায় চা উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হলেও আমেরিকার জলবায়ুতে চা উৎপাদন হয় না বলে পরবর্তীতে এসব শ্রমিদের আরিজোনায় তুলা উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় বলে জানা যায়। বিষয়টি নিয়ে প্রচুর গবেষণার সুযোগ রয়েছে। হয়তো আজও আরিজোনায় কো-গোত্রের পূর্বসুরী হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশের চা শ্রমিক। বিষয়টি অবতারণার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কৃষ্ণাঙ্গদেরকে যেভাবে বরাবর ৪০৪ বছর পূর্বে ১৬১৯ সালে সর্বপ্রথম “পয়েন্ট কমফোর্ট’ (বর্তমানে যার নাম ভার্জিনিয়া) এ আনা হয়। প্রথম যাত্রায় কথিত আছে, মাত্র ২০ জনকে নিয়ে আসা হয়েছিল। এঙ্গোলার গ্রাম থেকে তাদের অপহরণ করে আনা হয়েছিল দাস হিসেবে। বাহন ছিল পর্তুগিজ প্লেব শিপ। ইউরোপের দিকে যাওয়া এই জাহাজকে নিউওয়াল্ড বলা হতো। আর সেই জাহাজ থেকে ইংরেজ জলদস্যুরা এক সংঘর্ষের পর ২০জন নিয়ো (তখন তাদের নিয়ো বলা হতো) ধরে নিয়ে আসে ভার্জিনিয়ার বন্দরে। তাদের এই আশা তৎকালীন নেটিভ আমেরিকান মহিলা ‘পোকাহনটাস’ (POCAHONTAS) এর বিধবা পত্নী

ও সেই কলোনির সেক্রেটারি জন রোলফ নোট করে রেখেছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। অপহরণ করা ৩৫০জন আফ্রিকান নিয়ে সানহুয়ান বাতিস্তা নামে জাহাজটি সন্ত্রাস, ক্ষুধা ও মৃত্যুর আহাজারির মধ্য দিয়ে তার যাত্রা চালিয়ে যায়। ইংরেজ জলদস্যুদের সাথে সংঘর্ষের পূর্বেও এই জাহাজ ছিল অনেকটা মৃত্যুপুরী। আর এই পর্তুগিজ জাহাজটি যখন মেক্সিকোর ভেরাকুজে নোঙর করে, তখন তাতে ছিল মাত্র ১৪৭জন আফ্রিকান। নোঙরের তারিখ হচ্ছে ৩০ আগষ্ট ১৬১৯। ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝখানে কয়েক মিলিয়ন কৃষ্ণাঙ্গ (কালো) মানুষ এ পথযাত্রায় হারিয়ে গেছে, তারা এ বিষয়ে সম্যক জানেন, কিংবা তার পরবর্তীতে বেনহার (BENHUR) যারা দেখেছেন, তারও এই যাত্রাপথ কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য কত নৃশংস ছিল, তা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে পারেন। কৃষ্ণাঙ্গদের অনেক ইতিহাস রয়েছে, যদিও অনেক কৃষ্ণাঙ্গ (কালো) জানেন ও বিশ্বাস করেন যে, তাদের কোন ইতিহাস নেই। তারা জানেন তাদের পূর্বপুরুষরা ১৬২০ সালের পূর্বে এদেশে বসবাস করছেন কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাসের ২০১৯ সালে ৪০০বছর পূর্তি অনুষ্ঠান পালিত হয়েছে। তাছাড়া আফ্রিকানদের আমেরিকায় আগমনের ৪০৪ বছর পূর্তি পালিত হয়ে গেল চলতি ফেব্রুয়ারি মাস ২০২৩এ। তবে গত ২০১৯ সালে এসে ১৬১৯ সালের ভার্জিনিয়া বিচ যে কৃষ্ণাঙ্গদের বরণ করেছিল, তাকেই বরণ করছে আমেরিকান মানুষ।

আরব্য উপন্যাসের ক্রীতদাসদের কথা কমবেশি বাঙালিদের জানা আছে। কারণ যারা ‘ক্রীতদাসের হাসি’ বা ‘সহস্র আরব্য রজনী’র গল্প পড়েছেন, তাদের ক্রীতদাস চরিত্র যে আরবের ইতিহাসে কত বিশাল স্থান দখল করে আছে, তা বলা বাহুল্য। ১৬১৯ সালে ইংরেজ বা ইংল্যান্ডের আমেরিকান কলোনিতে কৃষ্ণাঙ্গদের আগমন শুরু হয়েছে। আর এই আগত ব্যক্তিরাই আমেরিকায় ন্যাশন স্টেটের ভিত রচনা করেছে। সে জন্য ১৬১৯ সাল এতই মূল্যবান ইতিহাসে। ইতিহাসবিদদের বর্ণনা থেকে অনেকে মনে করেন, ব্ল্যাক হিস্টোরিকে এভাবে সরলীকরণ করা যাবে না। এই ইতিহাস অনেক জটিল। আজ কৃষ্ণাঙ্গদের (কালোদের) সংগ্রামের ইতিহাস: মানব সভ্যতার এক নির্মম বাস্তবতা।

একটা সময় ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতাঙ্গরা চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করত। শ্বেতাঙ্গ মানুষরা কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে মিশতো না। এমনকি শ্বেতাঙ্গ মানুষ বাসে উঠলে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের সিট ছেড়ে দিতে হতো। একই সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খাবার খেত না। বর্ণ বৈষম্য ছিল প্রকট। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রই প্রথম মানুষদের প্রতি বৈষম্যের জন্য প্রতিবাদ শুরু করেন। মূলত ১৯৫৫সালের ডিসেম্বর মাসের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার আনুষ্টানিক সিভিল রাইট মুভমেন্ট শুরু হয়। ১৯৫৫সালের ডিসেম্বর মাসে রোসা পার্কস নামের এক আফ্রিকান আমেরিকান মহিলাকে পুলিশ এরেস্ট করেছিল। পার্কসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সে অফিস থেকে বাসে করে ফেরার সময় আরেক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান যাত্রীকে কেন নিজের আসন ছেড়ে দেয়নি। তখন মার্টিন লুথার কিং এবং সোসাইটির সবাই মিলে এর প্রতিবাদ স্বরূপ আন্দোলন শুরু করেন। বাস সার্ভিস বয়কটের সিদ্ধান্ত নেন। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ নিজের গাড়ি চালিয়ে অফিসে আসা-যাওয়া করতে থাকেন। এ আন্দোলন অনেকদিন চলার পর এল্যাবামা রাজ্যে যানবাহনে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গদের ভেদাভেদ বেআইনি ঘোষণা করা হয়।

১৯৬৩সালের ২৮ আগষ্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক মুক্তি, চাকরির সমতা অর্জন এবং সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রতিষ্টার লক্ষ্যে লুথার কিং, বেয়ায়ড বাস্তির এবং আরও ছয়টি সংগঠনের সহায়তায় মার্চ অন ওয়াশিংটন ফর জব এন্ড ফ্রিডম (March on Washington for job and freedom) নামে এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেন। এই সমাবেশটি ছিল আমেরিকার ইতিহাসে সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ। এই সমাবেশে যোগ দেবার জন্য অসংখ্য মানুষ, ২০০০টি বাস, ২১টি স্পেশাল ট্রেন, ১০টি এয়ার লাইন্স এর সকল ফ্লাইট ও অসংখ্য গাড়িতে করে ওয়াশিংটনে এসেছিল। সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল লিংকন মেমোরিয়ালে। প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের সমাবেশ হয়েছিল ঐ মহাসমাবেশে। have a dream’ নামে লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে দেয়া সেই বিখ্যাত ভাষণ বিশ্বের সর্বকালের সেরা বাগ্মিতার দৃষ্টান্তগুলোর অন্যতম হয়ে আছে।

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র তার বক্তৃতার মাধ্যমে ঘোষণা দেন জাতিগত বৈষম্যের দিন শেষ করার। তিনি তাঁর ভাষণে শ্বেতাঙ্গদের কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর নির্যাতন, বঞ্চণা আর বৈষম্যমূলক আচরণের কথা তুলে ধরেন, ইতিহাস এই দিনটি মনে রাখবে, আমাদের জাতির ইতিহাসে মুক্তির মহান সমাবেশ হিসেবে। কিন্তু ১০০বছর পর মর্মান্তিক সত্য হচ্ছে, কৃষ্ণাঙ্গরা আজও মুক্ত নয়। শত শত বর্ষ পরও কৃষ্ণাঙ্গরা আজও দুঃখজনক ভাবে বিচ্ছিন্নতার শেকলে আর বৈষম্যের জিঞ্জিরে বাঁধা। শত শত বর্ষ পরও তাদের জীবন যেন ধন-সম্পদের বিরাট সমুদ্রের মাঝখানে এক নিঃসঙ্গ দারিদ্রের দ্বীপ। শতবর্ষ পরও কৃষ্ণাঙ্গরা মার্কিন সমাজের এক কোণে নির্জীব দশায় পড়ে আছে, হয়ে আছে নিজ ভূমে নির্বাসিত ।

আমাদের প্রজাতন্ত্রের স্থপতিরা যখন সংবিধানের সেই দারুণ কথাগুলো লিখছিলেন এবং দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা, তখন তাঁরা এমন এক চেকে সই করেছিলেন, প্রতিটি আমেরিকান যার উত্তরাধিকারী সেটা ছিল। সব মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অধিকার, মুক্তি ও মুখ সন্ধানের নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি। আজ পরিস্কার হয়ে গিয়েছে, আমেরিকা সেই প্রতিশ্রুতিপত্র খেলাপ করছে, অন্তত তার কৃষ্ণাঙ্গ ও এশিয়ার বাদামী নাগরিকদের বেলায়।

তিনি তাঁর ভাষণে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় তুলে ধরেন, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক আচরণ, বিদ্বেষ ও নির্যাতনের কথা। বলেন যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কোন প্রাপ্তি নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত কৃষ্ণাঙ্গরা (কালোরা) নির্যাতনের শিকার হবে, হোটেলে-মোটেলে থাকার অধিকার না পাবে, কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গদের জন্য, এমন সাইনবোর্ড থাকবে। আমি জানি আজ বা কাল আমাদের সময় সংকটময়। তবুও আমি স্বপ্ন দেখি এ জাতি জাগ্রত হবে, মানুষের বিশ্বাসের মূল্যায়ন হবে। জাতিগত বৈষম্যের অবসান হবে। সব মানুষ জন্মসূত্রে সমান । আলোড়ন তোলা ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ ভাষণের প্রভাবেই ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আইন ও ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়।

বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর সকল বিখ্যাত নেতাই নাকি জীবনে অন্তত একবার জেলে গিয়েছেন। কিং এর ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। তিনি জীবদ্দশায় ২৯বার জেলে গিয়েছেন বলে জানা যায়। এর মধ্যে কয়েকবার গিয়েছেন বেসামরিক আইন অমান্য করার কারণে, আবার কয়েকবার তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে মিথ্যা অভিযোগের কারণে। যেমন-১৯৫৬সালে আলবামাতে ২৫কিলোমিটার/ প্রতি ঘন্টা গতিতে গাড়ি চালানোর রাস্তায় তিনি নাকি ৩০কিমি/প্রতি ঘন্টা গতিতে গাড়ি চালিয়েছেন, এই মিথ্যা অভিযোগেও তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল। ১৯৬৪ সালের ১৪ অক্টোবর তিনি তাঁর অহিংস আন্দোলনের জন্য শান্তি রক্ষায়, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও আরও অনেক পুরস্কার লাভ করেন। মার্টিন লুথার কিং যতদিন বেঁচেছিলেন নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সাদা-কালো নয় সব মানুষ সমান এর জন্য লড়েছিলেন। ১৯৬৮ সালের

৪ এপ্রিল শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থী আততায়ীর গুলিতে এই মহান নেতা নিহত হন। তাছাড়া ১৯৭১ সালে ‘Why a oppose the war in vietnam’ এ্যালবাম এর জন্যে লুথার কিংকে মরণোত্তর সম্মাননা দেয়া হয়। অন্যদিকে মার্কিন লুথার কিং ছাড়া আর মাত্র দুইজন ব্যক্তির সম্মানে আমেরিকায় জাতীয় ছুটি পালন করা হয়ে থাকে। সেই দুইজন হলেন, জর্জ ওয়াশিংটন এবং ক্রিস্টোফার কলম্বাস। মজার বিষয় হলো এদের মাঝে একমাত্র কিং ই আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তি যার সম্মানে আমেরিকায় জাতীয় ছুটি পালন করা হয়।

অনেকে হয়তো জানে না, হাইতি ল্যাটিন আমেরিকার প্রথম দেশ যারা স্বাধীন হয়েছিল। ১৮০৪ সালে ফরাসি ঔপনিবেশকারীদের বিরুদ্ধে তাদের এই স্বাধীনতা ছিল কৃষ্ণাঙ্গ (কালো) ক্রীতদাসের ত্যাগ ও বীরত্বের ফসল। আমেরিকা জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে ১৭৭৬ সালে যখন স্বাধীনতা অর্জন করেছিল তখন তাদের হয়ে লড়াই করেছিল হাইতিয়ানরাও। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ পর্যন্ত আমেরিকান সিভিল ওয়ারের সময় সাউথে যখন শ্বেতাঙ্গদের প্রচন্ড আগ্রাসন, তখন বহু কৃষ্ণাঙ্গ (কালো) মানুষ পালিয়ে হাইতি চলে গিয়েছিল। হাইতি নামটাই আমেরিকার বহু কালো মানুষের আশা আর প্রেরণার প্রতীক। যদিও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোন্দলের কারণে স্বাধীনতার এত বছর পরেও দেশটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিত।
কৃষ্ণাঙ্গ (কালো) মানুষরা কি চিরকাল অপমানিত হবে ? অশালীন উক্তির শিকার হবে? এইতো ক’দিন আগেই। (ফেব্রুয়ারি-২০১৯) হোয়াইট হাউজে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট দলীয় সিনেটরদের সঙ্গে এক বৈঠকে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘মলদ্বার এর সঙ্গে তুলনা করেছেন হাইতি, এল সালভাদর ও আফ্রিকান দেশগুলোকে।

২০১০ সালে হাইতিতে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথা কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। প্রায় ৩লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল তখন। সেই সময় মানবিক দিক বিবেচনা করে আমেরিকান সরকার প্রায় ৫০হাজার হাইতিয়ানকে নিজেদের দেশে আশ্রয় দিয়েছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল ২০০১ সালে সালভাদরের ভূমিকম্পের পরে। তখন ট্রাম্প প্রশাসন নিয়েছিল টেম্পোরারি প্রটেকশন স্যাটাস সংক্ষেপে টিপিস-এ আসা এসব উদ্বান্তকে ডিপোর্টেশন করে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার। তাছাড়া দ্বীপরাষ্ট্র হাইতিতে বেশ কয়েকবার ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। সব মিলে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। সে কারণে আশ্রয় নেয়া হাইতিয়ানদের অনেকে আর নিজ দেশে ফিরে যেতে চান না। তাদেরকে আবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তুলনা করলেন ‘মলদ্বার যার বাংলা অর্থ টয়লেট এর সঙ্গে।

আমেরিকান সচেতন জনগণ ট্রাম্পের মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছে। ফ্লোরিডার মিয়ামিতে ও নিউইয়র্ক সিটির হারলেমে বিরাট প্রতিবাদ সভা হয়েছিল। বিভিন্ন সামাজিক মানবাধিকার সংগঠনের সদস্যরা ট্রাম্প টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে নিজেদের পশ্চাৎদেশ প্রদর্শন করেছিল। তবে হাইতিয়ানরা অসম্ভব পরিশ্রমী আর হাইতি হলো আফ্রিকান কালো মানুষদের স্বাধীনতার প্রতীক। ট্রাম্পকে এসব জানতে হবে। তবে ভালো রাজনীতিবিদ বা ভালো বক্তা হতে হলে ভালো ভালো বই পড়তে হবে, মহীয়সীদের আত্মজীবনী পড়তে হবে, ইতিহাস জানতে হবে। আর সকল ক্ষুদ্রতা পরিহার করে মুক্ত বুদ্ধির চর্চা করে মানুষে মানুষে হৃদ্যতা বাড়িয়ে মানবতার জয়গান গাইতে হবে।

আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের (কালোদের) অগ্রসর হওয়ার জন্য আরো অনেক কিছু বাকি। তবে যে ঢেউ জেগেছে, তাতে হাওয়া লাগলে তা যে সাগরে উর্মী তুলবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কৃষ্ণাঙ্গদের (কালোদের) মহীরোহ ড. মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছেন- Commit yourself to the Nobel Struggle for equal right. You will make a Better Nation of your country, And a fines world to live in’

অর্থাৎ ‘সম-অধিকারের মতো মহৎ সংগ্রামের জন্য নিজে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হও। তুমি নিজেকে উন্নত লোক

হিসেবে গড়তে পারবে, তোমার দেশকে মহাজাতিতে পরিণত করতে পারবে এবং এক অধিকতর মঙ্গলময় বিশ্ব

তৈরী করতে পারবে বসবাসের জন্য।’ আজ কৃষ্ণাঙ্গরা সেই মহামন্ত্রকে ধারণ করেছে।

সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আজ সাদা-কালোর দূরত্ব পরিবর্তিত। মানুষ এখন বর্ণ বৈষম্য থেকে সরে এসে যোগ্যতার বিচারে মানুষকে ভাবতে শুরু করেছে। এই যে চিন্তধারার পরিবর্তন, সমতা এটাই মার্টিন লুথার কিং য়ের সার্থকতা। তাঁর জন্যই আজ আমেরিকায় ইকুয়াল রাইটস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

(লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, নুরজাহান মেমোরিয়াল মহিলা ডিগ্রী কলেজ, সিলেট। পিএইচ ডি ফেলো, নিউইয়র্ক)।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো সংবাদ পড়ুন
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায়: বাংলাদেশ হোস্টিং