কবি সফিকুল ইসলাম সোহাগ, আমার অত্যন্ত প্রিয় এক অনুজ কবি।
সমকালীন কবিতার মহাসড়কে দৃপ্ত পদচারণার এক সোনালী মাইলফলক তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থ: শপথ ভাঙার ইশতেহার। বছর দুয়েক আগে কবি আমাকে স্বহস্থে বইটি উপহার দিয়েছিলেন, বইটি পড়ে এর পাঠপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার এক সুপ্ত বাসনা জাগে মনে মনে, কিন্তু একধরনের আলস্য ও দৈনন্দিন ব্যস্ততা এই বাসনার বিপক্ষে কার্যকর হয়ে ওঠে। শেষমেষ জোর করে সকল অন্তরায় তাড়িয়ে আজ কলম ধরেছি লিখতে। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে, এই মহান কবি ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী সকল তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে। কবি নিজে তরুণ যৌবনদীপ্ত, বিদ্রোহী কবিতাও যৌবনের জয়গানে টইটম্বুর, সুতরাং এই পক্ষপাত স্বাভাবিক।
বইয়ের ফ্ল্যাপ খুলেই পাঠকের চোখে পড়বে কবির লেখা কয়েক পংক্তি: ঝলসে দেবে দাও/ মুখরিত প্রাণের শোভাযাত্রা বন্ধ করবে করো/ সুশোভিত ফুলের বাগানে আগুন দাও/ মাটিতে পুঁতে রাখো গ্রেনেড/ তবু- কিঞ্চিত পরিমাণ ও বিচলিত হবোনা/- এর শেষ স্তবকে কবির বাসনা মথিত উচ্চারণ:
তারপর-
সুখের পসরা সাজাবো
গড়বো উন্মুক্ত সুখের নিবাস,
মুল্যবোধের সৌখিন পিড়ামিড।
কবির কাছে মুল্যবোধ পিড়ামিড সমান। পৃথিবীতে মানুষের আশ্চর্য নির্মাণ পিড়ামিড। এর নির্মাতা হওয়া সাধারণের পক্ষে সম্ভব নয়, এটি অসাধারণের কাজ। কবি সেই কঠিন আয়াসসাধ্য কাজে হাত দিতে চান মুল্যবোধের জাগরণ ঘটাতে।
লক্ষণীয় বিষয়, আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে কবিতার সূচীপত্র আছে, কিন্তু কবির লেখা নিজস্ব কোন ভূমিকা ভণিতা নেই। এর দায়ভার হয়তো কবি সচেতনভাবেই সহৃদয় পাঠকমহলের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন? এবং কবিতাগ্রন্থের নাম দিয়েছেন ‘শপথ ভাঙার ইশতেহার’ মুল্যবোধের পতন দেখলেই, কোন শপথের বেড়িবাঁধে আটকে না থাকার ঘোষণা এই নামকরণে প্রকট হয়েছে। বইয়ে সূচীবদ্ধ কবিতার প্রথমটির নাম: ‘অবিনশ্বর ভাবনার স্মারক’ এর প্রথম স্তবকে তিনটি লাইন:
অবিশ্রান্ত লিখে যাও
বিপন্ন মুক্তির করিডোরে
প্রতিবাদী প্লাবনে উছলে উঠুক যৌবণ।
মানুষের মুক্তি যেখানে বিপন্ন বিধ্বস্ত, সেখানে প্রতিবাদের কবিতা গান গল্প উপন্যাস, নাটক প্রবন্ধ নিবন্ধ, অবিশ্রান্ত লেখা হোক, নিজেকে এবং অন্যান্য লেখকদের কে এই ফরমাশ দিচ্ছেন কবি। এর ফল কী হবে? তার উত্তর পাই বর্ণিত কবিতার শেষ স্তবকে: জবান খুলে যাক/ কামড় বসাক অত্যাচারী বিষ পিঁপড়ে/ আবদ্ধ রাষ্ট্রের মগজ ধোলাইয়ে। রাষ্ট্র যখন আবদ্ধ ও নিস্ক্রিয় জনগনের মৌলিক মুক্তি ও সুখশান্তির ব্যাপারে, তখন বিষ পিঁপড়ের কামড় ছাড়া এই অচেতন মগজে চেতনা ফেরানো অসম্ভব। এটি অমঙ্গলের মগজে, মাঙ্গলিক চেতনার কামড়।
গ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই আমার বোধের গহীনে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, আমি যদি প্রতিটি কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেই, তবে লেখা দীর্ঘায়তন হবে। সন্দেহ নেই এতে পাঠকের বিরক্তি উৎপাদনের, সুতরাং আত্মসংবরণ শ্রেয়। এছাড়া কবিতার কোন সর্বজনমান্য একক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সুযোগ নেই। পাঠকভেদে কবিতার কার্যক্ষমতা ভিন্নভিন্ন মাত্রায় ক্রিয়াশীল হয়। আমার চেতনার ভেতর কবির কবিতার রঞ্জন রশ্মি কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছে আমি সেটাই বর্ণনা করতে বসেছি, আমার রসনার মিষ্টান্নবোধ অন্যের রসনায় সমান মিষ্টি হবে এমনটি ভাবা উচিত ও নয়। আমি কোন আলোচক সমালোচকের চশমা চোখে এই লেখাটি লিখতে বসিনি, একজন সতীর্থ কবিকে তাঁর কবিতা পড়ে, নিজস্ব রসভোগের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ব্যক্তিগত খোলা চিঠি লিখতে বসেছি।
একদম সোজা কথায় মুল্যায়ন করছি কবি সফিকুল ইসলাম সোহাগ একজন পরিপক্ক কবি। তাঁর কাব্যগ্রন্থের পদ বিন্যাসে ভাষাও শব্দালংকারের শক্তিশালী প্রয়োগে আমি এই সাক্ষ্য পেয়েছি।
বইয়ের ভিন্ন ভিন্ন কবিতার মেজাজ সতন্ত্র, তবে একটি লুকানো ঐক্য রয়েছে প্রতিটি কবিতায়। রাষ্ট্র এবং সমাজে দুর্নীতির প্রতিবাদ এবং দেশের মানুষের লাঞ্ছিত বঞ্চিত জীবন বেদনার প্রতি সহানুভূতিশীল সমবেদনা এবং প্রতিকারের খোঁজ মেলে কবিতাগুলোয়।
কবি তার কলমে রাষ্ট্রীয় অপরাজনীতি ও দুর্ণীতির বিষবৃক্ষের গোড়ায় চকচকে কুড়ালের মত আঘাত করেছেন। এছাড়া ‘অনিশ্চিত প্রহসনের ঘোলাজল’ কবিতায় পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় স্বদেশী রাজনৈতিক
মদদ পুষ্ট, পুঁজিবাদী শুয়োরের গতরে কলমকে তীক্ষ্ণ বল্লমের মতো, ধারালো ফলার মতো, উঁচিয়ে কবি সজোরে ঘা মেরেছেন এভাবে: মাল্টিন্যাশনাল মঞ্চগুলো আশির্বাদ নেয় তলাবিহীন পলিটিক্সের/ পোহায় অশ্রাব্য বচনে সংসদীয় জানালার রোদ/ উত্থাপিত নথিপত্র ঘুমায় লাল ফিতার গিট্টুতে।
এছাড়া (অশ্রাব্য বচনে নিমজ্জিত) এই বাক্যবন্ধ ইশারাভিকাফি।
আইনসভার মজলিসের জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসা বক্তব্যে রাজনৈতিক পরস্পরবিরোধী উত্তপ্ত অশ্রাব্য বাণী আমাদের কর্ণভেদ করে।
সর্বোপরি উপমা রূপক চিত্রকল্প ও কাব্যভাষা নির্মাণে কবির স্বকীয়তা চোখে পড়ার মতো। আধুনিক যুগে, কবিদের দুর্বোধ্য কবিতা নির্মাণ পাঠকের মনকে কবিতা বিমুখ করে তুলেছে। এই অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়, কবি সফিকুল ইসলাম সোহাগ এই অভিযোগ থেকে দায়মুক্ত থাকার বলিষ্ঠ প্রয়াসী। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত শব্দালংকার একেবারে পাঠকের আটপৌরে মুখের ভাষার নিকটাত্মীয়, আমি এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারি।
সত্যনিষ্টা বোধহয় কবিদের স্বভাবগত? কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সত্যের পক্ষে তার কবিতায় লিখেছেন: সত্য যে কঠিন/ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম/ সে কখনো করেনা বঞ্চনা।অন্যদিকে কবি সফিকুল ইসলাম সোহাগের সত্যনিষ্টার নমুনা তাঁর কবিতা থেকেই আমি তুলে দিচ্ছি:
সত্যের কাতারে লাইন ধরি,
মানুষের বাচাল কোলাহলে কান রাখিনা।
ভীড়তে অপারগতা দেখাই ছলনার জালে। তর্কেও যাইনা।
(কবিতা: আমার বৈধতা)
সবশেষে বইটি পাঠক প্রিয়তা পাবে, আলোচক সমালোচকের নজরবন্দি হবে, আমার এ আশাবাদ দৃঢ়। আমি বইটির বহুলপ্রচার, লেখক কবির সুস্বাস্থ্য সুদীর্ঘায়ূ কামনা করি। বরাবর এই তরুণ কবির লেখনী গতিশীল থাকুক এবং আরো অজস্র সুবর্ণপংক্তি ঝলমলে হোক তার কবিতার খাতা।
কবি: পরিচিতি: মোঃ সফিকুল ইসলাম সোহাগ,
জন্ম: সুনামগঞ্জ জেলাধীন , মধ্যনগর উপজেলার গড়াকাটা গ্রামে।
পিতা: মোঃ দুলাল মিয়া, মাতা: নুরজাহান খাতুন।
তাঁর স্ত্রীর নাম: সুলতানা জাহান রুনা, তাঁদের এক কন্যা: তাহনুম ইসলাম ও একমাত্র পুত্র: সাজিদ রাইয়ান।
পড়াশোনা: এমসি কলেজ থেকে বিএসএস (অনার্স) ও স্নাতকোত্তর এলএলবি সিলেট ল’ কলেজ।
পেশা: সরকারি চাকুরি, পূবালী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, চাকরি ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তিনি ‘স্থানীয় সরকার নিয়ে গবেষণা করছেন।
আলোচক: মোঃ সাদিকুর রহমান রুমেন
কবি লেখক, সমালোচক, কলামিস্ট সাংবাদিক।
গ্রাম: জামালপুর, থানা: জগন্নাথপুর, জেলা: সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ।
মোবাইল: ০১৭১৫৩৮৮৫৫৯
তারিখ: ১৫১০২০২৩ ইং
প্রিয় মহাশয় সালাম ও শুভেচ্ছা জানবেন। আমি জানতে আগ্রহী আপনার সাইটে কোন থিম ব্যবহার করছেন। ভালো লাগলো সবকিছু সুন্দর সাজানো গোছানো। যদি আপনার সহযোগিতা পাই ভালো লাগবে।