শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ

কবিতার স্বরূপ : আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা

শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ

প্রথা আমরা ভাঙবোই। কীভাবে? জবাবটি যেভাবেই হোক—কোন একটি পদ্ধতির কথা এসে যাবেই। পদ্ধতি মানেই কোন একটি প্রথার অনুসরণ। মানে প্রথাবদ্ধতা। প্রকৃতপক্ষে, কোন একটি প্রথাকে ভাঙতে হলে অন্য একটি প্রথার মাধ্যমেই তা করতে হয়। সেটি বিক্ষিপ্ত, সংগঠিত বা সংহত যা-ই হোক। এটিই স্বাভাবিক। তবে অধিকতর আধুনিক, উন্নত, যুগোপযুগী বা কল্যাণধর্মী প্রথা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই প্রচলিত প্রথাকে ভাঙ্গার চেষ্টা চলে থাকে।এভাবেই চলে প্রথাভঙ্গের পালা। এটিই প্রগতি। এটিই ক্রমবিকাশের গতিধারা। তবে কথা হচ্ছে, প্রচলিত প্রথার উৎখাতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিতব্য প্রথা যদি তুলনামূলকভাবে শ্রেষ্ট বলে বিবেচিত না হয়, তবে তো প্রচলিত প্রথাকে ভাঙ্গার কোন যৌক্তিকতা থাকে না। আবার প্রথাভাঙ্গার প্রক্রিয়ায় যদি অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে প’ড়ে কিংবা ঝুঁকির মুখে প’ড়ে, তবে তো সেটি হবে আত্মঘাতী। সেজন্যেই প্রথাভাঙ্গা বা প্রথাবিরোধিতার ক্ষেত্রে প্রয়োজন মুক্তবুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা-চেতনার আলোকে উদ্ভাবিত নীতিমালা কিংবা মূল্যবোধের সতর্ক ও বিচক্ষণ প্রয়োগ। না, এটা রক্ষণশীলতার রক্ষাকবচ নয়; নয় পেছন ফেরার নীতি-কৌশল বরং এটা প্রকৃত প্রগতির শুভধর্মী প্রায়োগিকতা।

কবিতার স্বরূপ কী? কবিতা অধিবিদ্যা নয়, নয় গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস বা এমন কোন বিষয়- যার ক্ষেত্রে কোন নিয়ম-সূত্র আক্ষরিক অর্থেই প্রযুক্ত হতে পারে। ব্যাকরণ বা অধিবিদ্যা না-ই থাকলো, তাই বলে কবিতার কোন দর্শনও থাকবে না, থাকবে না কোন পরিচিতি—এমনটি নিশ্চয়ই নয়। দর্শন অবশ্যই আছে। সবকিছুরই একটা দর্শন, বোধ বা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। স্পষ্ট বা অস্পষ্ট। প্রকট বা প্রতীকী। কবিতারও আছে। কবিতার সংজ্ঞা কী? তাৎক্ষণিকভাবে জবাবদান চাট্টিখানি কথা নয়। যেমনটি সহজ নয় দর্শনের সংজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রেও। দর্শনের ক্ষেত্রে যেমন বিভিন্ন বোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি ক্রিয়াশীল থাকে, যার প্রেক্ষাপটে সার্বজনীন বা স্বতঃসিদ্ধ-স্বীকৃত কোন সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পেতে পারে নি। এভাবে কবিতারও। কবিতা ও দর্শন যদিও একই বিষয় নয়, তবুও এদের মাঝে কিন্তু মিল আছে অনেক। যেমন, উভয়টির গতি হচ্ছে উপলব্ধির পথে—সত্য ও সুন্দরের পরমার্থিক অনুসন্ধানে। তবে এ-ই পরমসত্যের স্বরূপ, উপলব্ধি বা উপলব্ধির পদ্ধতির ক্ষেত্রে দার্শনিকদের যেমন আছে বিভিন্ন বোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিজাত সিদ্ধান্ত; তেমনি কবিতার ক্ষেত্রেও কবিদের আছে নিজস্ব বোধ বা উপলব্ধিজাত দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্ত।

ভিন্ন মত ও পথের এত সমাবেশ থাকা সত্ত্বেও একজন বুদ্ধিবাদী দার্শনিক একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিককে কিংবা অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক বুদ্ধিবাদী দার্শনিককে অস্বীকার করতে পারেন না—বড়জোর তাঁর সমীক্ষার পদ্ধতি ও সমীক্ষিত সিদ্ধান্তের সাথে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন কিন্তু ‘এটি দর্শন নয়’ বলে উড়িয়ে দিতে পারেন না। কেননা, দর্শনচর্চার ক্ষেত্রে এমনকিছু নিয়ম আছে; যেগুলো স্বতঃসিদ্ধ। একইভাবে বলা যায়, কবিতারও কিছু নিয়ম-পদ্ধতি ও গঠনগত পরিচিতি আছে। যদিও এগুলো দর্শন বা অধিবিদ্যার মত আক্ষরিক অর্থে অলঙ্ঘনীয় নয়, তবুও কবিতাকে একেবারেই বিধিহীন বলার অবকাশ নেই। এ বিধিহীনতাকে কবি’র স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করাও অসংগত। কারণ, স্বাধীনতার মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। 

কবিতা এর অস্তিত্বগত অবকাঠামোর আবশ্যক উপাদান সংগ্রহ করে প্রকৃতির জগৎ থেকে। প্রত্যক্ষলব্ধ এ ইন্দ্রিয়-সংবেদন বৌদ্ধিক প্রকল্পে ভাবগত সৌন্দর্যে ঋদ্ধ হয়ে অভিনব আধ্যাত্মিক অনুভব সৃষ্টি করে। এটিই নান্দনিকতা। শিল্পের প্রাণস্পন্দন। বিশুদ্ধ অর্থে এ-অনুভবের উৎস পরমসত্তার প্রকাশমান দিক। এজন্যে, কবিতা ইন্দ্রিয়জ হয়েও অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার পরম অনুভব আত্মস্থ করে। কালিক হয়েও উত্তীর্ণ হয় কালের সীমা। ধারণ করে মহাকাল—ভাবের বোধগম্য জগৎ। ঐতিহ্যিক হয়েও হয় আধুনিক। আবার আধুনিক হয়েও আধুনিকতাকে অতিক্রম করে। আধুনিকোত্তর প্রাগ্রসর চিন্তা ও চেতনার প্রগতিশীল প্রবহমানতায়। এজন্যেই কবিতার স্বভাব বরাবরই উত্তরাধুনিক। এটা নতুন কিছু নয়। এ-কারণেই এ-কে দেরিদা-ফুকোর উত্তরাধুনিক প্রকল্প বলার অবকাশ নেই। এটি কবিতার স্বরূপগত আবহমান বৈশিষ্ট্য। কবিতার ক্রমবিকাশের প্রগতিশীল দিক। তবে দেরিদা-ফুকোর উত্তরাধুনিক চিন্তা-চেতনার সাথে কবিতার পুরোপুরি মতৈক্য হোক বা নাহোক—এর বেশকিছু প্রবণতার সাথে ঐকমত্য হতেই পারে। বিশেষ করে বলা যেতে পারে, যে-সব মহান মানবিক মূল্যবোধের অস্বীকৃতির ফলে আধুনিকতার সংকট সৃষ্টি হয়েছে; যেগুলোর সাথে কাব্যচেতনার কোন বিরোধ নেই—উত্তরাধুনিকতায় সেগুলো অস্বীকৃত হচ্ছে না। এটি ইতিবাচক। যেমন ইতিবাচক আধুনিকতাবাদের শ্রেষ্ঠ অবদান মুক্তবুদ্ধিচর্চা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, উদারনীতি ইত্যাদি।

কবিতা হচ্ছে শিল্প। শিল্পের স্বরূপ হচ্ছে নান্দনিকতা; যা সৌন্দর্যবোধজাত আত্মতৃপ্তির নামান্তর। আর আত্মতৃপ্তি পরতৃপ্তিকে অস্বীকার করে হয় না। যথার্থ আত্মতৃপ্তি সেটিই-যেটি পরতৃপ্তির সাথে সমন্বিত হয়—প্রতিবন্ধক, অতৃপ্তি বা কষ্টের কারণ না হয়। এভাবে নান্দনিকতা শুভবোধ বা নীতিবোধের সাথে অনিবার্যভাবে সম্পৃক্ত হয়ে প’ড়ে। কিন্তু আধুনিকতাবাদ নির্বিচারে শুভ ও সুশৃঙ্খল জীবনের অনিবার্য প্রায়োগিক সত্য যেমন নীতিবোধ বা বিবেক ও শৃঙ্খলার উৎস ও গ্যারান্টি ‘ঈশ্বর’, ‘আত্মা’ ও ‘পরকাল’ ইত্যাদি অধিবিদ্যক মানদণ্ড ও ধর্মীয় মূল্যবোধ-আদর্শ ও উত্তরাধিকার-ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে ‘বৈজ্ঞানিক সত্য’-এর নামে ‘যান্ত্রিক সভ্যতা’ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। এরই অনিবার্য পরিণতিতে পরম সত্য থেকে বিচ্যুত বিশ্বসভ্যতার শৃঙ্খলা, সাম্য, শান্তি ও স্থিতি মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত কাব্যচেতনা কোন বদ্ধচেতনার ধারক নয়। নয় প্রতিবন্ধী বরং মুক্তবুদ্ধিবৃত্তিক—শুভকামী মানবিক-নান্দনিক। এ-প্রয়োজনে কবি যেমন স্পুটনিক-এ অভিযাত্রী হতে পারেন, তেমনি পারেন বোরাক বা নুহের নৌকায় চড়তে বা বেহুলার ভেলায় লখিন্দর হয়ে ভেসে যেতে। কুরআন-পুরাণে প্রত্যক্ষ করতে পারেন সাম্প্রতিক বিজ্ঞানসত্য, কম্প্যুটার-ল্যাপটপে প্রত্যক্ষ করতে পারেন স্বর্গের দরজা-জানালা। এ-ই হচ্ছে কাব্যচেতনার ব্যাপ্তি—মৃত্তিকা থেকে মহাশূন্য আর কাল থেকে মহাকাল যার বিষয়। কবি হচ্ছেন এরই বিষয়ী।

কবিতায় মানবিক আবেদন, কমিটমেন্ট বা আশাবাদের অস্তিত্ব অস্বীকারের উপায় নেই। কারণ, কবি’রা এ মৃত্তিকারই মানুষ। সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের নাগরিক। সংবিধিবদ্ধ। নৈতিকসত্তা। শুভকামী মানবিক বোধকে এড়িয়ে যাবার অবকাশ তাদের নেই। যদিও একজন শিল্পী বা সৃষ্টিশীল সত্তা হিসেবে প্রচলিত সাধারণ নাগরিক স্বাধীনতার চেয়ে তার স্বাধীনতার ব্যাপ্তি অনেকটাই ব্যাপক থাকা আবশ্যক। আর এর ব্যাপ্তি ততটাই হওয়া উচিত ; যতটা তার সৃষ্টিশীলতাকে প্রবহমান ও প্রগতিশীল রাখার পক্ষে আবশ্যক—ব্যাহত না করে, আবার স্বেচ্ছাচারী করে না তোলে। অবশ্য এটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট শিল্পী বা কবি’র সৃষ্টি এবং সৃষ্ট শিল্পকর্মের শুভধর্মী স্বরূপের ওপর। মানবিক কমিটমেন্ট বা আবেদন কবিতায় অবশ্যই শিল্পপদবাচ্য। নান্দনিক অনুভবের প্রবহমানতায় অস্তিত্বশীল হয় যাবতীয় অভিজ্ঞতা, আবেগ-উপলব্ধি ও বক্তব্য। এটি কবিতার শিল্প-প্রকরণগত সত্যের স্বরূপ। এ সত্যের কাঠামোয় আবর্তিত হন কবি—আবর্তিত হয় কবি’র আত্মোপলব্ধি, জীবনবোধ ও বিশ্বাস। অন্তরঙ্গ নান্দনিকতার মিশেলে কবি তার আত্মগত অনুভবকে প্রকাশ করেন যথার্থ শব্দ-প্রকল্পে। তবে এ বোধ বা বিশ্বাস কবি’র কবিত্বের মূল্যায়নে বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য হল তার বোধ বা বিশ্বাসকে কতটা শৈল্পিকভাবে কাব্যরূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন—কেবল সেটিই। 

‘কবিতা’ কথাটি শোনার সাথে সাথেই আমাদের এমনকিছু অভিজ্ঞতাজাত ধারণার উপলব্ধি ঘটে; যেগুলো আমাদের মনস্তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত। তবে এ-কথা ঠিক যে, কালের বিবর্তনে বা সময়ের প্রয়োজনে বস্তু বা বিষয়গত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। কাব্যচিন্তাও এর ব্যতিক্রম নয়। এটাকে আমরা প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার প্রতিফলক বিবেচনা করি। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, কালের বিবর্তনে আমাদের চিন্তা-চেতনা-পদ্ধতি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হলেও আমাদের এমনকিছু মৌলিক বোধ বা উপলব্ধি আছে; যেগুলো সার্বক্ষণিকভাবেই অপরিবর্তিত থেকে যায়। যেমন,”আমরা মানুষ”—এই বোধ, ধারণা ও পরিচিতি থেকে আমরা কোনভাবেই বিচ্যুত বা বিস্মৃত হই না—হতে পারি না বা এ-কে বদলাতে পারি না। আমরা মানুষ দু’পায়ে হেঁটেছি, ঘোড়ায় চড়েছি, গাড়িতে চড়েছি, প্লেনে চড়েছি—সময়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন যানে সওয়ার হয়েছি কিন্তু সকল ক্ষেত্রে আমি মানুষ মানুষই থেকেছি। সময়ের প্রয়োজনে গতিশীল হয়েছি কিন্তু কোনভাবেই এ-গতিশীলতা আমার “মানুষ” নামক সত্তাটির স্বরূপগত আকার ও কাঠামোগত পরিচিতিকে পরিবর্তিত করতে পারে নি,কেননা, মৌলিক অবকাঠামোগত আনুষঙ্গিক দিকগুলো সকল ক্ষেত্রেই অক্ষুন্ন থেকেছে। কবিতার ক্ষেত্রেও এ-সত্যটি এড়িয়ে যাবার অবকাশ নেই। 

কবিতা হচ্ছে বোধজাত ভাবের প্রকাশ ; যা শব্দপ্রকল্পে বিশেষ ভঙ্গিমায় আত্মপ্রকাশিত হয়। আর এ-বিশেষ ভঙ্গিমাটি হচ্ছে শব্দপ্রকল্পটি কবিতা হয়ে ওঠার শিল্পকৌশল। এ-শব্দপ্রকল্পটি গতিশীল ও গীতিময়। এ-ই গীতিময় গতিশীলতাই কবিতার প্রাণপ্রবাহ। এটি কবিতার মৌলিক ধারণা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে ছন্দ-তাল-লয় ইত্যাদি এ-মৌলিক ধারণা থেকেই প্রসূত। এজন্যে, ছন্দ কবিতার মৌলিক ধারণার অনিবার্য বিষয়—প্রয়োগটি কীভাবে হবে সেটি ভিন্ন বিষয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়। কিন্তু সরাসরি ছন্দ বা ছন্দের অনুরণনকে অস্বীকার করা যায় না। কেননা, এটি অস্বীকৃত হলে কবিতা পরিণত হবে গদ্যে বা গল্পে—হারাবে অস্তিত্ব। গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ সম্পর্কেও আমাদের এমনকিছু প্রতিষ্ঠিত বোধ বা ধারণা আছে; যেগুলো বিশিষ্টার্থক-পরিচায়ক। ধারণাগত এ-বিশিষ্টতাই পৃথকভাবে এদের সনাক্ত করে। এজন্যেই, একটিকে আরেকটির মধ্যে ঘুলিয়ে ফেলার কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারে না; যেহেতু এক্ষেত্রে কোন অনিবার্য আবশ্যকতার প্রশ্ন জড়িত নেই। সেজন্যেই, নিছক প্রগতির প্রশ্নে এটি অহেতুক আরোপ—এমনটি বলা বাহুল্য হবে না।

কালের বিবর্তনে কবিতা বিবর্তিত হবে—এটি স্বাভাবিক ও সত্য ধারণা। তবে বিবর্তন যেভাবে যেটুকুই হোক, কবিতাকে কবিতাই থাকতে হবে। অর্থাৎ মৌলিকত্ব বজায় রেখেই বিবর্তিত হতে হবে। মানবদেহ অনিবার্য প্রত্যঙ্গগুলোর সমন্বয়ে যেভাবে গড়ে ওঠে; কবিতাও সেভাবে এর মৌলিক বৈশিষ্টগুলোর সুষম সমন্বয় আর বিকাশের মাধ্যমে কাব্যিক কাঠামো গড়ে নেয়। নির্মাণ করে শব্দের শিল্পিত শরীর। বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অর্জন করে প্রগতি। দৃশ্যমান দেহ আর অদৃশ্য আত্মার সমন্বয়ে মানবসত্তা গঠিত। দেহ ঐন্দ্রিয়িক অর্থাৎ সরাসরি প্রত্যক্ষণযোগ্য আর আত্মা পরোক্ষ প্রত্যক্ষণের বিষয় হিসেবে অতীন্দ্রিয় অনুভূতিসাপেক্ষ। দেহ অভিজ্ঞতার আধেয় হিসেবে বস্তুগত আর আত্মা বৌদ্ধিক হিসেবে ভাবগত। আবার, আত্মাহীন দেহ যেমন মৃত, তেমনি ভাবহীন ভাষার নিষ্পাণ শব্দপ্রয়োগে কারিশমা থাকলেও যথাপদবাচ্য কবিতা হয়ে ওঠে না। শব্দ হলো কবিতার দেহ আর ভাব হলো প্রাণ। সুতরাং বস্তু ও ভাবের যথোপযুক্ত সমন্বয় ছাড়া জীবনধর্মী কবিতা নির্মিত হতে পারে না। ভাব-ই হচ্ছে ভাষা বা বক্তব্যের গতিশীলতা। সেজন্যে, কাব্যে এর আবশ্যকতা অনিবার্য। এটি কবিতার উৎস বা প্রেরণা। এ ছাড়া কবিতা অচল। জীবনবিমুখ। শব্দের সুনিয়ন্ত্রিত শরীর থেকে ভাবোচ্ছ্বাসের ঐশ্বর্য যদি নিঃসৃত না হয়, তবে এ-কে কবিতা বলি কীভাবে! এজন্যেই, ভাবহীন নিষ্প্রাণ নিরেট গদ্যকবিতা সত্যিকার অর্থে আবেদনহীন। ভাব মানেই একটি আবহ যা সংবেদন ও আবেদন সৃষ্টির উপাত্ত। আবেগ আর উচ্ছ্বাসের অহর্নিশ অনুরণন। নান্দনিকতার অসীম অতীন্দ্রিয়লোকে সসীম ইন্দ্রিয়জের নিরন্তর ছুটে চলা। আর কবিতা সে-তো এ-নান্দনিকতারই পাঠ। ভাবের বিনম্র উচ্চারণ—ভাবের বিভবে ভাষার শরীর কম্পমান সংবেদী। ভাব ভাষার শরীরকে পুষ্টি যোগায়, স্বাস্থ্যবান করে। ভাবের আশ্রয়ে ভাষা বিন্যস্ত হয়ে শব্দের নান্দনিক শরীর গঠন করে; যাকে আমরা কবিতা বলে থাকি। 

আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতা প্রসঙ্গে প্রশ্ন উত্থিত হতে দেখা যায়। কবিতায় দুর্বোধ্যতা বাস্তব কি-না? এর উপযোগিতা আছে কি-না? দুর্বোধ্যতার উৎস কোথায়? দুর্বোধ্য কবিতা কালোত্তীর্ণ বা দীর্ঘজীবী হতে পারে কি-না ইত্যাদি প্রশ্ন এক-ই ধারাবাহিকতায় উঠতে দেখা যায়। প্রথমত বলা যায়, কবিতা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতায় প্রাপ্ত প্রতীতি বা সংবেদনের মাধ্যমে অতীন্দ্রিয়ে উড্ডয়নের অনুভব। জগৎকে জানার একটা স্বতন্ত্র প্রচেষ্টা ; যা বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম বা মনোবিজ্ঞানকে জানার মতো নয়। বিকাশে আলাদা, আভায় আলাদা, মননে আলাদা, স্থিতধী-স্বরূপেও আলাদা—নান্দনিকতা যার লক্ষ্য। সময়ের অগ্রসরতার সাথে-সাথে পরিবর্তিত হয় স্থিত ধারণাসমূহের, মূল্যবোধের, চিন্তা-চেতনার; যা ব্যক্তিপর্যায়ে হতে পারে ভিন্নতর। এর প্রয়োগসাপেক্ষেই কবিতায় দুর্বোধ্যতা সৃষ্টি হয়। কবিতার ভাষা, বিষয়, ভাবনা বা ভাবভঙ্গিমার সাথে যখন-ই পাঠক আত্মস্থ হতে ব্যর্থ হয়, মূলত তখনই কবিতাকে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ নিতে হয়। মোটকথা, উৎস বা স্বরূপের দিক থেকে কবিতা ভাবগত। এজন্যে ভাবগত বিরোধ হতেই পারে। আর এ-বিরোধ জন্ম দিতে পারে দুর্বোধ্যতার। সেজন্যে, কবিতার ক্ষেত্রে এ-দুর্বোধ্যতা অস্বাভাবিক নয়। 

আবার, রহস্যময়তা তন্ময়তার কারণ। তন্ময়তা বোধের শরীর। বোধের শরীরে আসঙ্গ সহবাসের মধ্য দিয়েই আত্মোপলব্ধির আত্মতৃপ্তি ঘটে—সৌন্দর্য আবিষ্কৃত হয়। সুতরাং বোধ বা উপলব্ধির ক্ষেত্রে ব্যক্তিক ভিন্নতা দুর্বোধ্যতার দেয়াল তৈরি করতেই পারে। এজন্যে কবিতার দুর্বোধ্যতাকে দায়ি করা যুক্তিসংগত নয়। কবিতার একটি নিজস্ব আমিত্ব আছে। সে-ই আমিত্বই কবিতা। কবিতার রূপ আছে, অরূপও আছে। সবটা মিলেই কবিতার সত্তা। রূপ-অরূপের দ্বন্দ্বই কবিতার স্বরূপ। তবে, স্বরূপের অনুসন্ধানে রূপকে অবলম্বন করতেই হয়। আধেয়কে অর্জন করতে হলে যেমন আধারকে আয়ত্ত করতে হয়। কবিতার আধার হলো এর শব্দরূপ। দেহ যেমন আত্মার ধারক; কবিতার ক্ষেত্রে শব্দও তা-ই। দেহ আমিত্বের প্রতিনিধি হয়েও আমিত্বের আড়াল সৃষ্টিকারী। সেরূপ শব্দ কবিতার প্রকাশক হয়েও কবিতার স্বরূপ-সত্যকে প্রতীকী আড়ালে শিল্পিত করে রহস্যাবৃত করে রাখে। শব্দরূপ এ-আধারকে আয়ত্তে আনা যখন পাঠকের কাছে কঠিন হয়ে প’ড়ে, তখন-ই দেখা দেয় দুর্বোধ্যতা।

কবিতার ধরনটাই এমন যে, তা অধিকমাত্রায় আত্মগত। তবে, প্রকৃত কবিতা আর ধীসম্পন্ন তথা প্রকৃত পাঠকের মাঝে আপাত দুর্বোধ্যতার দেয়াল প্রতিবন্ধক হলেও পরিণামে তা ধসে যাবেই; যদি সে-ই দেয়ালটি কৃত্রিম কাব্যচমক সৃষ্টির জন্য আরোপিত না হয়। অর্থাৎ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অযৌক্তিক-অনাবশ্যক আড়াল নিয়ে থাকা না হয় অথবা যদি কবিসত্তায় চৈন্তিক বা মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রম, বিকৃতি বা বৈপরিত্য না থাকে। সোজাকথায় বলা যায়, চিন্তার সহজাত ও স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা যদি অব্যাহত থাকে, তবে বোধের সাথে একাত্ম হওয়া কিংবা এর সমান্তরাল বা কাছাকাছি অবস্থান নেয়া অসম্ভব নয়। একেবারে স্বচ্ছ উপলব্ধি যদি না-ও হয়, তবু স্বাভাবিক কাব্যসৌন্দর্য আস্বাদনের মাধ্যমে একটা অনির্বচনীয় নান্দনিক বোধ জন্ম নেবেই। কবিতার সার্থকতা এখানেই। দুর্বোধ্য হলেও একেবারে অবোধ্য নয় বরং বোধির সমান্তরাল—নান্দনিক ঐক্য-প্রকাশক। কবিতার এ-নান্দনিকতা তৈরি হয় সৃষ্টিশীলতার গহন টানে। সুতরাং সৃষ্টিশীল পাঠকমননে নান্দনিক কবিতা আলোড়ন তুলবেই। কবিতার সহজাত দুর্বোধ্যতার স্বরূপ-বিশ্লেষণ মূলত এটিই।

কবিতায় আরোপিত দুর্বোধ্যতা সম্পর্কে বলা যেতে পারে এটি কবি যশঃপ্রার্থীর চতুর কাব্যচেষ্টা। উপমা, প্রতীক বা চিত্রকল্পের অচিন্তনীয় অবাস্তব ও অসম্ভব প্রয়োগ, অপ্রচলিত আভিধানিক বা বহিরাগত শব্দের অপপ্রয়োগে কাব্যিক গাম্ভীর্য বা চমক সৃষ্টির কৌশল যা বোধের অতীত বা বোধবিভ্রান্তিকর। অসংলগ্ন উচ্চারণের অর্থহীন জালবুনন—প্রলাপসদৃশ। এসব যদি কবিতা হয়, তবে কবিতার স্থায়িত্ব প্রশ্নসাপেক্ষ হবেই। স্বল্পমেয়াদী আবেদনও যদি না থাকে; তবে সীমাবদ্ধ কালের জন্যে হলেও এটি স্থিতি পাবে না—কালোত্তীর্ণ বা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া তো প্রশ্নাতীত। কবিতাকে একান্তই আত্মগত তথা নিছক কবিগত ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবা কী খুব-ই জরুরি? কাব্যধর্মী আত্মমগ্নতাকে অব্যাহত রেখে— পাঠকপ্রিয়তাকে উপেক্ষা না করে আলো-আঁধারীর মত একটা তন্ময়তাবোধ সৃষ্টি হলে খুব কী অকাব্যিক হবে! কবিতার একজন পাঠক ইন্দ্রিয়জ সুখ নাইবা পেলো; তাই বলে কী অতীন্দ্রিয়ের স্বপ্নসুখও পাবে না? কাব্যরসিকের মনে এ-প্রশ্নের উদ্ভব হওয়া অযৌক্তিক নয়। এজন্যে, কপট দুর্বোধ্যতা নয়; সুবোধ বিমূর্ততাই কবিতার কাম্য। 

অতীতের কবিতা ছিল শুধুই ছন্দোবদ্ধ। এখনও যে শুধু ছন্দেই লিখতে হবে এমনটি নয়। সময়ের প্রয়োজনে গদ্যভঙ্গিমায় কবিতা হচ্ছে—অসামান্য ও কালোত্তীর্ণ কবিতা। কালিক প্রয়োজনে কবিতা আরও ভিন্ন রূপে আবির্ভুত হবে কিন্তু কবিতা সকল কালে কবিতাই থেকে যাবে—যদি কবিতা তার স্বকীয়তাকে সতর্ক-সযত্নে অক্ষুণ্ন রেখে যেতে সক্ষম হয়। গদ্যভাষণে ভাবোত্তীর্ণ কবিতা হচ্ছে—কালের বিচারে আধুনিক মনন ও চাহিদায় তা ঠিকই আছে। কিন্তু এ-প্রক্রিয়াটিকে যদি অতি আধুনিক করার উদ্দেশ্যে বাড়াবাড়িরকমভাবে প্রসারিত করা হয় কিংবা অধিক বাস্তববাদী করার লক্ষ্যে ভাবের আবহ বা রেশটুকু বিসর্জন দেয়ার চেষ্টা করা হয়; তবে সে-ই রোবট কবিতাটিকে কী আর প্রকৃতই কবিতা বলা যাবে? যাবে না। কেননা, কথিত কবিতাটির কাঠামোতে তখন আর কবিত্ব থাকবে না—কবিতার আত্মা এ-থেকে নির্বাসিত হবে—এটি হবে কবিতার কংকাল।

আমরা অবশ্যই স্বীকার করি যে, কবিতা সাহিত্যের সবগুলো শাখার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিল্পিক তথা শিল্পদক্ষতাসম্পন্ন বিষয়। কবিতা ভাবের বাহন। ভাব নান্দনিক অনুভবের আধার। এজন্যে গদ্যরূপ সাহিত্যকর্মকে রসোত্তীর্ণ ও সাবলীল করার লক্ষ্যে কাব্যিক আবহে গদ্যের গাঁথুনি দেয়া হয়; কিন্তু সেজন্যে তো সে-ই গদ্যসাহিত্যকে আমরা কবিতা বলতে পারি না। কবিতায় গল্প হতেই পারে—কবিতার নিজস্ব আঙ্গিক স্টাইলে। কিন্তু গল্প বা উপন্যাসে এ-গাল্পিক বিষয়টি আসবে ভিন্নরূপে-বিস্তৃতভাবে। কবিতা কবিতাই। গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ স্বকীয়ভাবে তাই-ই। কবিতাকে গদ্যে লাগামহীনভাবে বিলীন করে দিলে কবিতার ভবিষ্যৎ আশংকিত হবেই। কবিতার স্বকীয় প্রাঙ্গনেই চলুক নিরীক্ষা—অর্জিত হোক প্রগতি—সংরক্ষিত থাকুক স্বাধীনতা। কবিতা ও গদ্যসাহিত্যের স্বরূপ ও সীমা স্পষ্ট। সুতরাং একটা বিশুদ্ধ গদ্যরচনাকে কবিতা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা অবশ্যই অকবিসুলভ।

‘ছন্দই কবিতা’—অতীতে এমনটি বিবেচনা করা হত। কালের ধারায় বহুবিধ ছন্দের সফল প্রয়োগ কবিতাচর্চায় লক্ষ করা যায় এবং তা কবিতাকে এগিয়েছে সন্দেহাতীতভাবেই। আধুনিক গদ্যকবিতায় প্রত্যক্ষভাবে ছন্দের প্রয়োগ দৃশ্যমান না হলেও অন্তর্গতভাবে ছন্দ-তাল-লয় ইত্যাদির অনুরণন অবশ্যই আছে; যা কবিতার পাঠে-উপলব্ধিতে ঠিক-ই ধরা প’ড়ে। কালিক বিবেচনায় প্রক্রিয়াটি সফল বলা যেতেই পারে। তাই বলে ছন্দোবদ্ধ কবিতাকে অচল ভাবার কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারে না, কেননা, আধুনিক শব্দচয়ন, ছন্দের নিরীক্ষা ও ভাবভঙ্গিমায় ছন্দোবদ্ধ কবিতাও যথার্থ আধুনিক আবহ ধারণ করে আধুনিক কবিতা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। একইভাবে, আধুনিকোত্তরকালেও বিচিত্র নিরীক্ষাধর্মী ছন্দের প্রয়োগে উত্তরাধুনিক কবিতাও রচিত হতে পারে। কেননা, ছন্দ আধুনিকতা বা উত্তরাধুনিকতা তথা কালিক প্রগতির জন্যে বাধা নয় বরং কবিতার একটি অনিবার্য বিষয় হিসেবে ছন্দ অস্বীকৃতি নয়, প্রগতির অধিকার রাখে। অতীত ব’লেই অগ্রাহ্য হবে—পেছন ফেরা হবে এমনটি ভাবা সবক্ষেত্রেই সমীচীন নয়। যেমন, ক’দশক আগেও মার্ক্সবাদী দর্শন ও সাম্যবাদী কবিতাচর্চাকে অগ্রসরতা ও প্রগতির প্রতীকরূপে বিবেচনা করা হয়েছে—রচিত হয়েছে অনেক-অনেক অসামান্য কবিতা। এখন সময় বদলেছে—বদলেছে সাম্যবাদ বা মার্ক্সবাদ প্রশ্নে দৃষ্টিভঙ্গিও। কথা হচ্ছে, সাম্যবাদ ব্যর্থ হতে পারে—প্রত্যাখ্যাত হ’তে পারে পৃথিবী থেকে; তাই ব’লে সাম্যবাদী সে-ই অসামান্য কবিতাগুলোকে ব্যর্থ বলা যাবে কী? অবশ্যই না। কেননা, মার্ক্সবাদ কবি’র বিশ্বাস, আদর্শ বা আদর্শনিষ্ঠা—এটা কবিতার ক্ষেত্রে বিচার্য বিষয় নয়; বিচার্য হল কবিতার কবিত্ব তথা কাব্যগুণ অর্থাৎ কাব্যিক বিচারে কবিতাটি কতটুকু সার্থক তা-ই। কবি পুঁজিবাদী না সমাজবাদী, হিন্দু না মুসলিম, পূর্বের না পশ্চিমের এ-সব বিবেচ্য হ’তে পারে না। এ-প্রসঙ্গে বাংলাভাষার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য—”কবি হ’তে পারেন ধর্মবিশ্বাসী, নাস্তিক কিংবা এগনস্ট”।

কবিতায় শব্দপ্রয়োগে যথেচ্ছ অনিয়ন্ত্রণ কাম্য নয়। অতি আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টায় বাংলাভাষী কাব্যিক সৌন্দর্যবোধের সাথে সংগতিহীন অপ্রচল-অবোধ্য বিদেশি শব্দের জোর প্রয়োগ কবিতার নান্দনিক উপলব্ধির সহায়ক তো নয়-ই বরং অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্বোধ্যতায় অভিযুক্ত করে। ফলে পাঠক দূরে নিক্ষিপ্ত হয়। এর অর্থ এ নয় যে, কোনভাবেই বিদেশি শব্দ কবিতায় প্রযুক্ত হবে না। বরং প্রকৃত কথা হচ্ছে, এমন অনেক ইংরেজি, ফার্সি, আরবি, হিন্দি, উর্দু বা সংস্কৃত শব্দ আছে; যেগুলো আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি তথা জীবনাচারে একাত্ম হয়ে গেছে—এগুলোকে অস্বীকার করার কোন উপায় যেমন নেই, তেমনি নেই কোন প্রয়োজন বা যুক্তিও। এগুলো কবিতায় আসবে স্বাভাবিকভাবেই। আবার এমন কিছু বিদেশি শব্দ আছে, যেগুলো প্রচলিত না হলেও অপরিচিত নয়। অর্থ উদ্ধারের জন্যে অভিধান নিয়ে বসতে হয় না—কাব্যিক প্রয়োজনে এগুলোও কবিতায় আসতেই পারে। এ-ছাড়া যা আসবে তা হবে কাব্যিক সৌন্দর্যের অনিবার্য উপাত্ত। কৃত্রিম দুর্বোধ্যতা সৃষ্টির মাধ্যমে কাব্যিক চমক দেবার নিমিত্তার্থক হিসেবে নয়।

আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি গণতান্ত্রিক, উদারনৈতিক ও মুক্তবুদ্ধিবৃত্তিক। উত্তরাধুনিকতা এগুলোকে অস্বীকার করতে পারে না। পূর্বপ্রতিষ্ঠিত বদ্ধমূল ধারণা, অন্ধবিদ্বেষ বা আক্রোশ যৌক্তিক কারণেই আধুনিক বা উত্তরাধুনিক কোন কালেই কবিতার চর্চা, বিচার-বিশ্লেষণ তথা মূল্যায়নে প্রযুক্ত হতে পারে না। আদর্শ-ধর্ম-রাজনীতি ইত্যাদি কবি’র বিশ্বাস ও জীবনাচারের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিগত বিষয়। ব্যক্তিগত বিশ্বাস ব্যক্তিসত্তার স্বাধীনতা ও অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট। এ বিশ্বাস ও আচারের প্রতিফলন সংশ্লিষ্ট কবিসত্তার কাব্যকর্মে ঘটবে—এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বাসের ওপর হস্তক্ষেপ কিংবা এর আলোকে কাব্যের বিচার-বিশ্লেষণ তথা মূল্যায়ন মুক্তবুদ্ধি বা উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। অথচ বাংলাদেশের অবস্থা দুঃখজনকভাবে এর বিপরীতধর্মী। বিষয়টির সম্যক উপলব্ধির জন্যে প্রসঙ্গত বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের একটি সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে:

ভোরের কাগজ সাময়িকী, ১৩/১১/’৯৮

আহমদ মোস্তফা কামাল : ———–। এই যে আপনার নামের সঙ্গে এখন একটি অভিধা যুক্ত করা হচ্ছে সমকালীন বাংলার প্রধান কবি—আপনার কি মনে হয়নি যে, এর মধ্যে একটু রাজনীতি কাজ করছে?

শামসুর রাহমান : কি রকম?

কামাল : আমাদের কৈশোর কালে শুনতাম, বাংলাদেশে দু’জন গুরুত্বপূর্ণ কবি আছেন। একজন শামসুর রাহমান আরেকজন আল মাহমুদ। অথচ আল মাহমুদ এখন আর কোথাও নেই তার রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে। তাকে যে কবিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত তার সেসব কবিতা তো আর মরে যায়নি। এখন যদি এমন হত যে, রাজনৈতিকভাবে আপনি আল মাহমুদের অবস্থানে থাকতেন আর উনি যদি আপনার অবস্থানে থাকতেন, তাহলে এখন যারা আপনাকে প্রধান কবি বলছে, তখন কি তারা বলতো?

রাহমান : না, বলতো না।

কামাল : তাহলে দেখা যাচ্ছে, আপনার কবিতা নয়, সৃষ্টিকর্ম নয়, আপনার অবস্থানই আপনাকে প্রধান কবির আসনে বসিয়েছে।——————-

কবি শামসুর রাহমানের স্বীকারোক্তি আর প্রশ্নকারীর মূল্যায়নধর্মী উক্তিবিশেষের সূত্র ধরে বলা যায় যে, পরিবেশ-পরিস্থিতি মোটেও ইতিবাচক নয়। রাজনৈতিক অবস্থান যদি হয় কাব্যবিচারের মানদণ্ড; তবে সৃষ্টিশীল কাব্যচর্চার পরিবেশ যে বিঘ্নিত হবে—এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, কবিত্বের স্বীকৃতি আর প্রতিষ্ঠা বড়ো বড়ো রাজনৈতিক দলে যোগদান বা তোষণনীতি অব্যাহত রাখলেই অর্জিত হবে। শামসুর রাহমান সত্য বলেছেন। কিন্তু এ-সত্য কী কাম্য হতে পারে? সাহিত্য বা কবিতার প্রকৃত পাঠক অবশ্যই বলবেন, না। সেজন্যেই, রাজনীতি বা অন্যকিছু দিয়ে নয়, কবিত্ব দিয়েই হোক কবিতা ও কবি’র মূল্যায়ন। অবশ্য, এ-কথাটি সত্য যে, কবিতায় রাজনীতি বা আদর্শবাদ উচ্চকিত হলে কাব্যধর্ম ক্ষুণ্ন হবার আশংকা থেকেই যায়—কবিতার কাঠামোটা হয়ে যাবে পোস্টার, চরণগুলো হবে একেকটা শ্লোগান কিংবা বক্তৃতায় ভারাক্রান্ত। এটিও কাম্য নয়। তবু যদি কেউ কাব্যিক সফলতার সঙ্গে কবিতায় রাজনীতি বা আদর্শবাদকে ধারণ করতে পারেন—সেটি ভিন্নকথা এবং তা প্রত্যাখ্যাত হবার আদৌ কোন আবশ্যকতা নেই। মোটকথা, কবিতা ও কবিকে রাজনৈতিক, আদর্শিক বা অন্য কোন মানদণ্ডে বিবেচনা করা অনুচিত। কবিতা ও কবি’র মূল্যায়ন হবে কবিত্বের মানদণ্ডে।

মালার্মে বলেন, “শব্দই কবিতা”। আক্ষরিক অর্থে সংজ্ঞাটি গৃহীত হলে মেনে নিতে হবে শব্দমাত্রই কবিতা; সুতরাং যে-কোন লেখাই কবিতাপদবাচ্য। কিন্তু কবিতা স্বরূপত তা নয়।

সেজন্য “শব্দই কবিতা” বচনটি নিছক আক্ষরিক নয়—অধিক ব্যঞ্জনাধর্মী। স্বরূপের দিক থেকে আমি বলবো, “শব্দের যে প্রয়োগ-ভঙ্গিমা মূল শব্দটির বস্তুগত সত্যের অধিক ভাবগত সত্য ও সৌন্দর্যে প্রকাশিত হয়, শব্দের সে-ই নান্দনিক ভঙ্গিমাটিই কবিতা।” 

কালিক দিক থেকে কবিতাকে অবশ্যই আধুনিক হতে হবে। কিন্তু এ-আধুনিকতাকে পাশ্চাত্য “আধুনিকতাবাদ”-ব’লে বিবেচনা করা যাবে না। আবার, একইসাথে কবিতাকে হতে হবে উত্তরাধুনিক ; কিন্তু এ-উত্তরাধুনিকতাকে পাশ্চাত্য তথা ফুকো-দেরিদার “উত্তরাধুনিকতাবাদ” ব’লে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না, সে-ভাবে, যে-ভাবে আধুনিকতাবাদ বিভ্রান্ত করেছিল। প্রথাবদ্ধতা বা প্রথাবিরোধিতা কোনটিই চরমত কবিতায় কাম্য নয় ; বরং কাব্যচিন্তা, আঙ্গিক ও প্রকরণে মৌলিক ধারণা, ঐতিহ্য ও প্রগতির সুষম সমন্বয়ই হোক কবিতার কালিক ও কালোত্তর বিবর্তনের শিল্পদর্শন। কেননা, এটিই কবিতার স্বরূপ। কবিতার মৌলিক ধারণার অনুষঙ্গে কবিতা ঐতিহ্যিক, আধুনিক ও উত্তরাধুনিক।

পরিশেষে বলতে চাই, প্রায় দেড়’শ বছর ধরে—বলা হয় বোদলেয়রের সময় থেকেই কবিতা আধুনিক হবার চেষ্টা করে আসছে। আধুনিক হবার এ-চেষ্টা অভিনব কিছু নয়। এটা নিসর্গের তাবৎ তৎপরতার অনুক্রমই বলা যায়। কেননা, থেমে নেই কিছুই—সম্মুখে এগোচ্ছে সবাই, সবকিছু। কবিতাও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে, এক্ষেত্রে সর্বত্র একইভাবে বা একই প্রক্রিয়ায় এ-প্রচেষ্টা চলে নি। আর্থ-সামাজিক, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে ভিন্নতর হয়েছে। সেজন্যেই বিভিন্ন দেশ ও জাতির ভাষা ও সাহিত্য এগিয়েছে স্বনিয়মে। আধুনিকতার স্থানিক দৃষ্টিভঙ্গিও গড়ে উঠেছে অনেকটা এরই ধাচে। ফলে বিভিন্ন দেশীয় আধুনিক কবিতার চেহারা ও চরিত্রে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবে, বৈপরিত্যের মধ্যেও একটা ঐক্যসূত্র থাকে; আর সেটি হচ্ছে কাব্যসত্য—কবিতার স্বরূপ বা শিল্পসত্য তথা নান্দনিকতাবোধ। এ-বোধ দেশকালে সীমিত নয়; এজন্যেই তা সার্বিক, কালোত্তীর্ণ ও বিশ্বজনীন। এরই প্রয়োজনে কবিতা এর সত্তার ধারণাটিকে অক্ষুণ্ণ রেখে স্বীয় অস্তিত্বকে বিবর্তিত করবে—বিকশিত করবে আধুনিকতার অনিবার্য উত্তরাধুনিক অনুষঙ্গে। [ শেষ ]